ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের বাড়িঘরে হামলার অভিযোগ ওঠে। তবে এসব হামলার ৯৮ ভাগই ছিল রাজনৈতিক।
গতকাল সোমবার প্রকাশিত মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, বিভিন্ন জায়গায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মাজার ভাঙা ও হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
পুলিশের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর হামলার এক হাজার ৪১৫টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশই রাজনৈতিক। ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ ঘটেছে সাম্প্রদায়িক কারণে। এসব ঘটনায় ৮৮টি মামলা দায়ের হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে ৭০ জন।
অধিকার বলছে, গত বছর প্রতিবেদন প্রস্তুতকালীন সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন শুরুর পর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন হাসিনা। জুলাই-আগস্টের এ অভ্যুত্থান দমন করতে গিয়ে হাসিনা সরকার গণহত্যাসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এ সময় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ছোড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার আশুলিয়ায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের হত্যা করে লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। যাত্রাবাড়ীতেও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালান আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশুসহ ৮৩৪ জন নিহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে ছাত্র ও শ্রমিদের পাশাপাশি আছে দিনমজুর। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন বলেও পুলিশ সদর দপ্তরের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৯ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ২৯৩ জন। একই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৮ জন। এর মধ্যে ১১ জনই মারা গেছে নির্যাতনে। গুমের শিকার ২০ জন, যার অর্ধেকই হয়েছে জুলাই বিপ্লবের সময়ে। কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছে ৮৩ জন।
আক্রমণ ও হেনস্তা থেকে রেহাই পাননি গণমাধ্যমকর্মীরাও। হামলায় আহত হয়েছেন ১৩৫ জন, লাঞ্ছিত হয়েছেন ২৭। আর মারা গেছেন পাঁচজন। এর মধ্যে চারজনই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়।
প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে। এতে গণহত্যা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন এবং অমানবিক ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ বাস্তবায়ন করতে এবং রিমান্ডের নামে নির্যাতন বন্ধের জন্য ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলার তাগিদ দেওয়া হয়। বলা হয়, সরকারকে নির্যাতনবিরোধী জাতিসংঘ সনদের অপসোনাল প্রোটোকল অনুমোদন করতে হবে।
গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাধীন মতাপ্রকাশেও। সুপারিশে বলা হয়, সর্বস্তরের মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকসহ সব মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা সব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং তাদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
সেই সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-সহ সব নিবর্তনমূলক আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে জোর দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।
খুলনা গেজেট/এনএম